ছবিঃ আমাজনের গহীন অরন্য (ইন্টারনেট হতে সংগৃহীত) |
আমাজন। দক্ষিন আমেরিকার সবুজ হৃদপিন্ড এবং পৃথিবীর সর্ববৃহৎ রেইনফরেস্ট। বিশ্বমাতার এই সম্পদটি পুরো গ্রহের প্রতিটি প্রানীকুলের অস্তিত্বকে বাচিয়ে রাখতে বড় ভূমিকা রাখছে।
আমাজন নামটি স্প্যানিশ পর্যটক ফ্রান্সেসকো দ্য ওরেলানার দেওয়া। তিনিই প্রথম ইউরোপীয় হিসেবে আমাজন নদী ধরে চিরহরিৎ এই বনে গিয়েছিলেন। অভিযানের সময় স্থানীয় ইকামিয়াবাস নামের নারী যোদ্ধাদের দ্বারা আক্রান্ত হন। তারপরই মূলত ‘আমাজন’ নামটি দেন। আমাজন শব্দের অর্থ নারী যোদ্ধা আমরা পৃথিবীর মানচিত্রের দিকে তাকালে সবুজে আচ্ছন্ন সবচেয়ে বড় যে অংশটি দেখতে পাই সেটিই হলো আমাজন। দক্ষিন আমেরিকার প্রায় ৭০ লক্ষ বর্গকিলোমিটার অববাহিকার ৫৫ লক্ষ বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে বিস্তৃত আমাজন বন। প্রায় ৯টি দেশ জুড়ে এই আমাজনের বিস্তৃতি। এর মধ্যে ৬০% রয়েছে ব্রাজিলে, ১৩% রয়েছে পেরুতে এবং বাকি অংশ রয়েছে কলম্বিয়া, ভেনেজুয়েলা, ইকুয়েডর, বলিভিয়া, গায়ানা, সুরিনাম এবং ফরাসি গায়ানাতে । পুরো পৃথীবিতে যে পরিমান রেইনফরেস্ট রয়েছে তার অর্ধেক টা আমাজন নিজেই দখল করে আছে। আমাজনের আয়তন এতটাই বিশাল যে আয়তনে এটা ৩৮টা বাংলাদেশের সমান।
এই বনে ৪০ হাজার প্রজাতির প্রায় ৩ হাজার ৯০০ কোটি বৃক্ষ রয়েছে এবং এই বনের গাছগুলো ১২০ফুট পর্যন্ত উচু হয়ে থাকে। পৃথিবীর মোট অক্সিজেনের ২০ শতাংশ উৎপাদিত হয় আমাজন বনে। সে কারনে একে পৃথিবীর ফুসফুস বলা হয়।বহু প্রজাতীর বৃক্ষরাজী ছাড়াও এতে রয়েছে ২৫ লাখ প্রজাতির কীট-পতঙ্গ, ১ হাজার ২৯৪ প্রজাতির পাখি, ৩৭৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ৪২৮ প্রজাতির উভচর এবং ৪২৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীসহ হাজারো প্রজাতির অজানা জীব-অণুজীব। গবেষকরা শুধু আমাজনের ব্রাজিল অংশেই ১ লক্ষ ২৮ হাজার ৮৪৩টি অমেরুদণ্ডী প্রজাতি আবিষ্কার করেছেন। আমাজনে পেরুর অংশের একটি গাছে ৪৩ হাজার প্রজাতির পিঁপড়ার সন্ধান মিলেছে। সমগ্র ব্রিটেনেও এখন পর্যন্ত এত প্রজাতির পিঁপড়ার দেখা পাওয়া যায়নি ।আমাজন বনের সবচেয়ে বিপজ্জনক ও হিংস্র প্রাণীর তালিকায় শীর্সে আছে জাগুয়ার, ব্লাক কেইমেন, অ্যানাকোন্ডা, পিরানহা, বিষাক্ত মশা, বিপজ্জনক বৈদ্যুতিক মাছ, পয়জন ফ্রগ ইত্যাদি। এসব প্রাণির যেকোণ একটির আক্রমনে আপনার মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
শোনা যায় আমাজন বনে বিষাক্ত পানি, মানুষখেকো সাপ,এবং আছে ফুটন্ত নদী, যার পানি নিচ থেকে টগবগিয়ে ফুটছে। এই রহস্যময় নদীর পানির তাপমাত্রা ৮৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস যা একজন সাভাবিক মানুষের জীবননাশের জন্য যথেষ্ট।
বন মানে নানা জীব-জন্তুর আবাস আর অবাধ বিচরন হলেও, আমাজনে প্রায় ৪০০’র বেশী উপজাতি বা নৃ গোষ্ঠী বাস করে। এখানে এমন কিছু নৃ গোষ্ঠী রয়েছে যাদের বাইরের জগতের ব্যাপারে কোন ধারনাই নেই। এমনকি তাদের চলাফেরাও আদিম যুগের বর্বরদের মতোই।
আমাজনের বুক চিরে বয়ে গেছে আমাজন নদী যা কিনা এই বনের আরেক বিস্ময়। দক্ষিণ আমেরিকার পেরুর আন্দিজ পর্বতের নেভাদো মিসমি নামক চূড়া থেকে এই নদীর উৎপত্তি। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৬ হাজার ৪০০ কিলোমিটার। প্রস্থ ১০ কিলোমিটার। আর এটি যেখানে সাগরের সাথে মিলিত হয়েছে সেখানে এর প্রশস্ততা প্রায় ২০২ মাইল । নীলনদের পর এটিই বিশ্বের বৃহত্তম নদী। দুনিয়ার যে কোনো নদীর তুলনায় বেশি পানি এই নদীতে বয়ে যায়। আমাজন নদী যেখানটায় আটলান্টিক মহাসাগরের সঙ্গে মিশেছে সেখানে প্রতি সেকেন্ডে ৪.২মিলিয়ন ঘন ফুট পানি সাগরে পতিত হয়। নিউইয়র্ক শহরে ১২ বছরে যত পানি ব্যবহৃত হয় আমাজন নদীতে তার চেয়েও বেশি পানি প্রবাহিত হয় একদিনে। পৃথিবীর মোট পরিচ্ছন্ন পানির ২০ ভাগ বয়ে যায় এই নদীতে।
আমাজনে আছে ৩০০০ প্রকারের ফল যার মধ্যে ২০০ প্রকারের ফল খাওয়ার উপযোগী। ধান, গম, আনারস, টমেটো, আলু, কলা, গোলমরিচ, কফিবীজ, কোকোয়াবীজসহ বিশ্বের ৮০ শতাংশ খাদ্যশস্যের আদি উৎস এই বন। আমরা যেসকল মেডিসিন ব্যবহার করি তার ৯০ শতাংশ গাছগাছালী দারা উত্তপাদিত হয় আর এই গাছগাছালীর ২৫ শতাংশই বহন করে আমাজন জঙ্গল। বিজ্ঞানী ও গবেসকরা বিশ্বাস করেন যে আমাজনে এমনও বৃক্ষ ও ওষুধী উদ্ভিদ আছে যা কি না ক্যান্সারের মত মহামারী রোগের প্রতিষেধক তৈরীতে ব্যবহৃত হতে পারে। কিন্তু বিপুল পরিমান সম্পদে ভরপুর এই আমাজনই আজ জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। গত আগস্ট মাসে লাগা ভয়াবহ আগুনে আমাজনের বহু গাছগাছালী ও বণ্যপ্রাণীর মৃত্যু ঘটে। এমনিতেই প্রতিবছর আমাজনে প্রতি মিনিটে একটি ফুটবল মাঠের সমান জঙ্গল ডিফরেস্টেশন হচ্ছে। এ বছর আমাজনে ৭৫ হাজারেরও বেশিবার আগুন লাগার ঘটনা ঘটে এবং গত আগস্ট মাসে ঘটে যাওয়া অগ্নিকান্ড ২০১৩ সালের পর সর্ববৃহৎ আগুণ লাগার ঘটনা বলে বিবেচিত হয়। শুধু আমাজনে লাগা আগুনের কারণে এ বছর এখন পর্যন্ত প্রায় ২২৮ মেগা টন কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে নির্গত হয়েছে। শুধু কার্বন ডাই-অক্সাইড নয়, বিপুলসংখ্যক গাছ পোড়ার কারণে বাতাসে বিষাক্ত কার্বন মনোক্সাইড গ্যাসও নির্গত হচ্ছে যার ফলে গোটা পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনে খারাপভাবে প্রভাব পড়তে পারে। আমাজনের এমন অবস্থা চলতে থাকলে আগামী পঞ্চাশ বছরের মধ্যে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ রেইনফরেস্ট হিসেবে আমাজন চিরকালের জন্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এর ফলে বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইড এর পরিমান বেড়ে যাবে এবং প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের অভাবে প্রাণিকূলের শ্বাসক্রিয়ার বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। তাই বন্ধুরা , চলুন আমরা বন উজারকরন থেকে বিরত থাকি । বেশি বেশি করে গাছ লাগিয়ে সবুজ বনায়ন গড়ে তুলি। পৃথিবীর ফুসফুস খ্যাত আমাজনকে রক্ষায় সূদুর বাংলাদেশ থেকে কিছু করতে না পারলেও অন্তত আমাদের সুন্দরবনকে বাচাতে এগিয়ে আসি।